মানবাধিকার নেত্রী অ্যাডভোকেট সুলতানা কামাল ২০১৬ খ্রিষ্টাব্দের ৬ নভেম্বর গাইবান্ধা গোবিন্দগঞ্জের আদিবাসী সাঁওতাল পল্লীর ঘটনার প্রতিবাদ ও সম্পত্তি ফিরিয়ে দেবার লক্ষ্যে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে দেশ থেকে আদিবাসীদের হারিয়ে যাওয়ার কথা রাষ্ট্রকে অবহিত করেছেন। গত ২৮ এপ্রিল জাতীয় প্রেসক্লাবে অত্যন্ত ক্ষুব্ধভাবেই আদিবাসীদের হৃদয়ের উপলব্ধি ও অব্যক্ত কথাগুলো উচ্চারণ করেছেন। তিনি বলেছেন, ‘জীবন ও সম্পদের ওপর যখন হুমকি সৃষ্টি হয়, তখনই মানুষ দেশত্যাগে বাধ্য হয়। সম্মানজনক জীবনযাপনের অধিকার হারিয়েই বিভিন্ন সময় এ দেশের সংখ্যালঘুদের দেশত্যাগের ঘটনা ঘটেছে।’
সম্মানজনক জীবনযাপন কে না চাই! দেশের চার সীমানায় বা নিজ গন্ডিতেও প্রতিটি মানুষই সম্মান নিয়ে বেঁচে থাকতে চাই। রাষ্ট্রীয় ঔদাসীন্যতার বিষয়টি গুরুত্বভাবে পর্যালোচনা করা দরকার। এখন নিজেকেই নিজের সম্মান রক্ষা করতে হয়। তবে বর্তমান প্রেক্ষাপটে আমি চাইলেও আমার সম্মান আমি রক্ষা করতে ব্যর্থ হচ্ছি। কয়েকটি বিষয় তুলে ধরলে পরিষ্কার হওয়া যাবে
প্রথমত -ধর্ষণ সমাজের একটি গর্হিত, অন্যায় ও ধর্মীয় বিরুদ্ধ কাজ। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতীয় সংসদে বলেছেন, ‘যৌন নিপীড়কের ক্ষমা নেই’। সমাজের দুর্বল শ্রেণির মধ্যেই আদিবাসীদের গণনা করা হয়। আদিবাসী নারীরা পরিবারের প্রয়োজনেই ঘরের বাইরের কাজগুলোতে সম্পৃক্ত হয়েছেন। মাঠে-ময়দানে নারী-পুরুষ সমান তালে কাজ করেন, এটি তাদের সমাজের দৃষ্টিতে সহনীয় এবং উপভোগ্যও বটে। আদিবাসীদের নিরক্ষরতা, ঐক্যহীনতা, বিচ্ছিন্নতা, রাজনৈতিক সম্পৃক্ততাহীন ও ক্ষমতায়ন এবং সংখ্যায় অল্প হওয়ার সুযোগে মতলববাজরা আদিবাসী নারীদের শ্লীলতাহানী, ধর্ষণ, গণধর্ষণ ও হত্যার মতো বর্বরতম ঘটনার শিকার হচ্ছেন। দৃষ্টান্তমূলক বিচারের অনিশ্চয়তায় আদিবাসীরা শঙ্কিত, আতঙ্কিত এবং স্থানান্তরিত হয়ে থাকেন। অ্যাডভোকেট কামাল বলেছেন, ‘নির্যাতনের শিকার অধিকাংশ নারী বিচার পান না। দেশে ৮৭ শতাংশ নারী নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন। তাদের মধ্যে মাত্র ৩ শতাংশ নারী বিচার পান।’ আদিবাসীরা সম্মানজনকভাবে জীবনযাপন করতে চাইলেও কপালের ভাঁজে কপালকেই দায়ী করে থাকেন।
দ্বিতীয়ত মৃত্যুর পরে জাতিগত ও ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের কবরস্থ/শশ্মানে নিয়ে যাওয়া যেমন সমস্যাই পড়তে হয়; অনুরূপভাবে ধর্মীয় রীতি অনুযায়ী অনুষ্ঠানাদি সম্পাদন করতেও ঝামেলার শিকার হয়ে থাকেন। নিজ সম্পত্তির ওপর দিয়ে মৃত ব্যক্তির লাশ নিয়ে যেতেও বাধাদান কিংবা কবরস্থান/শশ্মান ক্রমশই দখল হয়ে যাওয়াতে জীবনের শেষ আশ্রয়স্থল বা সম্মানজনকভাবে সৎকার্য সম্পাদিত হতে না পারায়; নিজেদেরকেও অসম্মানবোধ মনে হয়।
তৃতীয়ত ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলো ধর্মীয় উগ্রবাদীদের আক্রমণের শিকার হচ্ছে। মানুষের আত্মাধিকতা চর্চা করার অধিকার অবশ্যই মানব সৃষ্ট আইনের চেয়ে ঊর্ধ্বে। উপাসনালয়ে গমন, ধর্মীয় রীতি রেওয়াজ পরিপূরণের মাধ্যমেই নিজেদের আত্মিক সুখ-স্বাচ্ছ্যন্দের প্রাপ্তি কিংবা পরজীবনের বিষয়টিও যুক্ত রয়েছে। আমি যা বিশ^াস করি, সেটি যদি আমি উন্মুক্ত আকাশে, উন্মুক্ত বাতাসে উদ্যাপন করতে না পারি, তাহলে সম্মানজনক জীবনযাপন হতে পারে না। আমরা কী আমাদের নিজ নিজ ধর্মীয় বিশ্বাস রক্ষা করার জন্য সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিতে সমর্থ হচ্ছি!
সম্মানজনক জীবনের সংজ্ঞা সম্পর্কে জানতে চেয়েছিলাম পরিচিত অগ্রজের কাছে। তিনি আমাকে নিম্নোক্ত ঘটনা বর্ণনার মাধ্যমে বোঝাতে চাইলেন, একজন ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘুকে মাতৃভূমিতে থাকতে কিরূপ আচরণের মুখোমুখি হতে হয়। তার মতে, সম্মানজনক জীবনের সংজ্ঞা এরূপ ধরুন, ‘ক’ গ্রামের সংখ্যালঘু বাসিন্দা হরিদাস পালের পাটের জমি রয়েছে। ‘খ’ গ্রামে বৃহত্তর সম্প্রদায়ের বসবাস এবং সেই গ্রামের মোড়ল গণি মিঞার গরুতে ‘ক’ গ্রামের হরিদাস পালের পাট খেয়েছে, ক্ষেত নষ্ট করেছে এবং ঘটনাটি খোলা আকাশের নিচেই সংঘটিত হয়েছে। সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর সদস্য হরিদাস পাল বাধ্য হয়েই মোড়লের গরুটিকে সযতেœ ধরে নিয়ে এসে নিজ ঘরের পাশে খুঁটিতে বেঁধে রাখলেন। সাহসে কুলালো না যে, গরুটিকে স্থানীয় খোয়াড়ে দেবেন! বিষয়টি জানার পর গ্রামের মোড়ল গণি মিঞা দলবল নিয়ে সংখ্যালঘুর বাড়িতে আসলেন এবং দাপটের সাথেই হুমকি-ধামকি দিয়ে বলতে থাকলেন পাট-ই-তো খেয়েছে, অবলা জানোয়ার খোলা জায়গায় ছেড়ে দিয়ে একটু-আধটু খেয়েই থাকে; এতে তো অপরাধের কিছু হয়েছে বলে মনে হয় না। অবলা জানোয়ার খেলে হরিদাস বাবু একটু সহ্য করতে হয়, এত রাগ-ক্ষোভ করলে প্রতিবেশীর সাথে কিভাবে মিলেমিশে থাকবেন! হরিদাস পাল নির্বাক হয়েই দেখলেন গণি মিঞার লোকজন গরুটিকে খুঁটি থেকে খুলে নিয়ে সগৌরবে মিলিয়ে গেলেন। ঘটনাচক্রে কয়েকদিন পরই ‘ক’ গ্রামের হরিদাস পালের একটি ছাগল ‘খ’ গ্রামের গণি মিঞার পেয়ারা গাছের পাতা খেয়ে ফেলে। গণি মিঞা ছাগলটিকে পাতা খাওয়ার অপরাধে নিজ বাড়িতে নিয়ে আসে এবং দলবল নিয়ে ছাগলটিকে মেরে খেয়ে ফেলে। ওদিকে হরিদাস পাল খ গ্রামের গণি মিঞার কাছে উপস্থিত হলেন এবং বিষয়টির সুবিচার কামনা করলেন। গণি মিঞা হরিদাস পালের উদ্দেশ্যে বললেন, বাবু হরিদাস পাল তুমি তোমার ছোট জানোয়ার ছাগলকে সামলাতে পারো না, কিভাবে সংসার চালাও। দেখ, তোমার ছাগল আমার পেয়ারা গাছ নষ্ট করেছে, পাতা খেয়ে গাছের বেড়ে ওঠাকে ঠেকিয়েছে। বুঝতে পারো কত অন্যায় করেছো! আর হ্যাঁ, আমার লোকজন তোমার ছাগলকে দেখার পরই খাওয়ার জন্য বেশ আগ্রহ দেখিয়েছে। অন্যায় যেহেতু করেছো, আমিও তোমার জন্য কিছুই করতে পারিনি; আমার লোকজন তোমার ছাগলটিকে মেরে খেয়ে ফেলেছে। তাই বলি, অবলা জানোয়ারগুলোকে ঠিকমতো সামলাবে, নইতো দু-একবার এভাবেই সহ্য করে চলতে হবে। কবির ভাষায়Ñ
‘জগতের বুকের উপরে
বিপজ্জনক ফাটল খোলা যায়
…তবুও বিদ্যালয়ে এই শিক্ষা পেয়েছি যে,
বাস্তবতা ও যুক্তিবিদ্যা হল একই মুদ্রার
দুটি দিক।’
মিথুশিলাক মুরমু : আদিবাসী গবেষক ও লেখক।