নারী শব্দটি পৃথিবীতে বিভিন্নরূপে বারবার আসে। প্রত্যেক রূপে নারী কে সংগ্রাম করে যেতে হয় তার অবস্থান ঠিক রাখার জন্য। আমি দ্রৌপদী। মহাভারতের দ্রৌপদীর মতো মনোহরণকারী রূপ আমার নাই, আর পাঁচজন স্বামী আমার নাই। সংসারের কথায় পরে আসব, আগে আমার জীবনের শুরুটা সকলের জানা দরকার। এমনিতেই পুরুষশাসিত সমাজে নারীর সকল অনুভ‚তি, আবদার আর ভালোবাসাকে নাক্যামি বলেই মনে করা হয়। কয়েকজন বন্ধু অথবা কলিগ দেখবেন একত্রে গল্প করছে, কেউ একজন যদি তার বউয়ের দুর্নাম শুরু করে সাথে সাথে অতি আগ্রহে বাকিরা তাতে যোগদান করে। কারণ এর চাইতে সুন্দর বিষয় আর কিছু হতেই পারে না, নারীদের ক্ষেত্রে বেশিরভাগ সময় এর ব্যতিক্রমটাই দেখা যায়। এখন আসা যাক কোনো এক দ্রৌপদীর গল্পে। আমার জন্ম ১৯৬৮ সালের মার্চ মাসের কোনো এক সোমবার। তারিখ জানি না কারণ মা, বাবা এত শিক্ষিত ছিল না যে তারিখ মনে রাখতে হয় এটা জানবে। মা প্রতিবছর মার্চ মাস আসলে একটা সোমবার দেখে আমাকে পায়েশ রান্না করে খাওয়াতো, আমার ঠাকুমা এটা নিয়ে মাকে অনেক কথা শোনাত যে মেয়েদের নাকি জন্মদিন পালন করতে হয় না। আর মেয়ে যদি হয় আমার মতো কালো অনেকটা রবীন্দ্রনাথের কৃষ্ণকলির মতো।
সাল ১৯৭১ চারদিকে শুধু গোলাগুলির শব্দ। বাবার কোলে আমি আর কাকার কোলে আমারই ছোটো ভাই ধ্রুব। পরিবারের সবাইকে সাথে নিয়ে বাবা ভারতে চলে গেল, শুধু আমার ঠাকুরদা কিছুতেই রাজি হলো না, তার বাপ-দাদার ভিটা ছেড়ে সে যাবে না। অগত্যা ঠাকুরদা আর ঠাকুমাকে রেখেই আমরা সবাই ভারত গেলাম। আমাদের ক্যাম্প ছিল মুর্শিদাবাদে। সেখানে দেখলাম আমাদের মতো হাজারো মানুষ। এভাবেই ৯ মাস আমরা পার করলাম। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর দেশে ফিরলাম। বাড়িতে সব এলোমেলো হয়ে আছে। ভিটা বলতে আর কিছুই ছিল না। সব নতুন করে বাবা গড়তে শুরু করলেন। বাবা ব্যবসা করতেন। কাকাদের সাথে নিয়ে আবার নতুন করে কাপড়ের ব্যবসা শুরু করলেন। আমি ও পড়াশোনাতে মন দিলাম।
আস্তে আস্তে আমাদের সংসারে মানুষ বাড়তে থাকল। এক এক করে আরো ৬ ভাইয়ের জন্ম হলো আর সাথে ছিল ৫ কাকা, ৪ পিসি এককথায় বলতে গেলে বৃহৎ সংসার। বাবার একার উপার্জন দিয়ে এতজন মানুষের অন্নের সংস্থান চলত। আমি নামে দ্রৌপদী হলেও দেখতে কালো ছিলাম তবে রূপ ছাড়া সকল ভালো গুণই আমার মধ্যে ছিল। লেখাপড়ায় ভালো ছিলাম, ভালো রান্না, গান এককথায় গুণ বলতে যা বোঝায় সবই আমার ছিল। বাবা-মা’র খুব আদরের ছিলাম, সেইসাথে পরিবারের সবাই আমাকে ভালোবাসতো।
তখন স্নাতক ৩য় বর্ষে পড়ি। সুজল নামের একজনের সাথে কলেজে পরিচয় হয়েছে, সুজল আমাদের কলেজ থেকে পাশ করেছে ৭ বছর আগে, ওরই একবন্ধু আমাদের কলেজের লেকচারার হিসেবে যোগদান করেছে তার সাথেই দেখা করতে এসেছিল। সুজল দেখতে সুদর্শন, খুব সুন্দর করে কথা বলে। আমার সাথে পরিচয় হলো ওর এবং তারপর থেকে আমরা নিয়মিত দেখা করা শুরু করলাম। সুজলের বাবা মারা গেছেন, মা আর বড়ো এক বোনকে নিয়ে তার সংসার। সুজলের বড়ো তিন ভাই আলাদা থাকে। একসময় ওদেরও যৌথ পরিবার ছিল কিন্তু ওর দাদাদের বিয়ে হওয়ার পর অভাব-অনটনে পরিবার ভেঙে গেল। সুজল এম এ করেছে ইংরেজিতে। সরকারি স্কুলে চাকরি পেয়েছিল কিন্তু সে করবে না কারণ চাকরি করলে নাকি বেতন কম। এ কারণে সুজল একটা ছোটো ব্যবসা শুরু করেছে-চালের ব্যবসা, তার স্বপ্ন একসময় নিজের বাড়ি, গাড়ি হবে। আমি দেখতে কালো ছিলাম পরিবার এর সবার চিন্তা ছিল বিয়ে দিতে ছেলের বাবাকে অনেক টাকা দিতে হবে। এদিকে অন্যান্য ভাইদেরও বিয়ে দিতে হবে তাই সুজলের কথায় রাজি হয়ে গেলাম। ইতিমধ্যে আমি প্রাইমারি স্কুলে চাকরি পেয়েছি। সুজলের বাড়ি থেকে একদিন তার বড়ো ভাই, মা, দিদি আমাদের বাড়িতে এল। প্রথম দিন এসেই আমার বয়স জিজ্ঞাসা করল, বিয়ের পর টাকা বাপের বাড়ি দিতে পারব না এসব নিয়ে অনেক কথা বলে গেল। বুঝতে পারলাম যে পরবর্তী জীবনটা সুখের হবে না, তবুও সুজলের ওপর বিশ্বাস ছিল।
বিয়ের পরদিন থেকে আমার শাশুড়ি আমার নতুন নাম দিলেন কাক। চোখ দিয়ে অশ্রু ঝরলো, কালো ছিলাম বলে কোনোদিন আমার পরিবারের কেউ আমাকে অবহেলা করেনি। শুরু হল কথা দিয়ে অত্যাচার, সুজল কোনো প্রতিবাদ করত না, বলত সব ঠিক হয়ে যাবে। বিয়ের কয়েক মাস পর সুজলের ব্যবসায় ক্ষতি হলো, তার মা বলল এর জন্য আমিই দায়ী। আমার চাকরির টাকা দিয়ে সংসার চালানো শুরু করলাম। আমার বাবা জানতে পেরে সুজলের ব্যবসার জন্য টাকা দিলেন এবং অবাক হয়ে গেলাম যে সুজল হাত পেতে টাকা নিয়ে নিল। প্রথমবার আমি বুঝতে পারলাম যে কেন সুজল আমাকে বিয়ে করেছে? একবছর বাদে আমাদের কন্যা জন্ম নিল। সুজল এবং তার পরিবার কেউ খুশি হলো না, আমার মেয়ে আস্তে আস্তে বড়ো হতে লাগল। সুজল ছিল খুব অলস, ব্যবসায় তার মন ছিল না। সারাদিন বন্ধুদের সাথে আড্ডা করেই দিন কাটত। তার মেয়ে যে কোন ক্লাসে পড়ে এটার উত্তর ও তার জানা ছিল না। আমাদের সাথে দেখা হত রাতে। প্রতিবছর তার ব্যবসায় লস হত, ধার শোধ করতে আমার কাছ থেকে টাকা নিত। আস্তে আস্তে ভালোবাসার অর্থ আমার কাছে পরিষ্কার হয়ে গেল। ব্যবসা ছেড়ে চাকরি শুরু করল এবং চুরির দায়ে একদিন চাকরিটাও চলে গেল। তারপর থেকে ঘরে বসে থাকে এবং আমার উপার্জনের ওপর সে চলে।
ভালোবাসা অনেক আগেই আমার জীবন থেকে চলে গিয়েছিল, সুজল আমার গায়ে হাত তোলে, অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করে। আমার একমাত্র মেয়ে রুনি বারবার বলেছে যে মা তুমি ডিভোর্স দাও। আমি মুখ বুঝে অত্যাচার সহ্য করেছি শুধুমাত্র রুনির জন্য। আমাদের সমাজে ডিভোর্সি মায়ের মেয়েকে কেউ বিয়ে করে না। আজ আর কষ্ট হয় না কারণ মেয়েটা আজ বুয়েট থেকে পাশ করেছে। এখন একজন বিসিএস কর্মকর্তা, রুনিকে মানুষ করার জন্য দিনের পর দিন না খেয়ে এক কাপড়ে আমার দিন কেটেছে। তবে আজ ওর বাবা সুজল খুব গর্বের সাথে পরিচয় দেয় যে সে রুনিকে মানুষ করেছে, সেই রুনির গর্বিত বাবা। পুরুষশাসিত সমাজ তো, এ কারণেই সুজলেরা মাথা উঁচু করে বাঁচতে পারে।